শাখা সমূহ

যাকাত ও ফিতরা কি এক নাকি অভিন্ন? কখন কাকে কিভাবে যাকাত-ফিতরা প্রদান করবেন?

ইসলামে দান-খয়রাতের নানা মাত্রিক ধরন রয়েছে। তারমধ্যে অন্যতম হলো যাকাত। এটি ইসলামের ধর্মের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে যাকাত অন্যতম। মহানবী হযরত  মুহাম্মদ (স.)  যখন ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মদিনায় গিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা চালু করেন, তখন সে রাষ্ট্রে যাকাত ব্যবস্থার প্রচলন শুরু হয়।

অপরদিকে পবিত্র রমাদান মাসের শেষ দিকে এবং ঈদ-উল-ফিতরের আগে প্রদান করতে হয় ফিতরা। অনেকে যাকাত ও ফিতরাকে এক মনে করে থাকেন।

টুইট বাংলার পাঠকদের জন্য যাকাত ও ফিতরার আদ্যপান্ত বর্ণনা করে আজকের এই প্রবন্ধটি প্রকাশিত করা হলো

ফিতরা কি?

ফিতরা বা ফেতরা(فطرة) আররি শব্দ, যা ইসলামে যাকাতুল ফিতর (ফিতরের যাকাত) বা সাদাকাতুল ফিতর (ফিতরের সদকা) নামে পরিচিত। ফিতরা আদায় করা ইসলামি বিধান মতে ওয়াজিব। হাদিস শরিফে সদকাতুল ফিতরকে কাফফারাতুন লিসসাওম, অর্থাৎ রোজা অবস্থায় অবচেতনভাবে যে ত্রুটিবিচ্যুতি হয়ে যায়, তার কাফফারা বা ক্ষতিপূরণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

সাদাকাতুল ফিতর কারা আদায় করবেন?

প্রতিটি সামর্থবান মানুষের ওপর ফিতরা ওয়াজিব। যে ব্যক্তির নিকট ঈদের দিন তার ও তার পরিবারের খাদ্য-খোরাক বিদ্যমান রয়েছে এবং সেই সঙ্গে ফিতরা দেওয়ার সামর্থ্য আছে তার জন্য আল্লাহ তায়ালা ফিতরা ওয়াজিব করেছেন। অর্থাৎ কারোর কাছে একদিন ও এক রাতের খাদ্যের অতিরিক্ত পরিমাণ সম্পদ বিদ্যমান থাকলে তার নিজের ও পরিবারের সমস্ত সদস্যদের পক্ষ থেকে তাকে ফিতরা আদায় করে নিতে হবে।

সাহাবি হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর জমানায় আমরা সদকাতুল ফিতর প্রদান করতাম ‘এক সা’ (৩ কেজি ৩০০ গ্রাম প্রায়) খাদ্যবস্তু, তিনি বলেন, তখন আমাদের খাদ্য ছিল: যব, কিশমিশ, পনির ও খেজুর (বুখারি, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ২০৪) তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সদকাতুল ফিতর আদায় করতাম এক সা খাদ্যবস্তু, যেমন: এক সা যব, এক সা খেজুর, এক সা পনির, এক সা কিশমিশ।’ (বুখারি)

যাঁরা নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক নন, তাঁদের জন্য ফিতরা আদায় করা সুন্নত ও নফল ইবাদত। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন আমাদের মাঝে ছিলেন, তখন আমরা ছোট–বড়, মুক্ত ক্রীতদাস সকলের পক্ষ থেকে সদকাতুল ফিতর আদায় করতাম এক সা খাদ্য, অর্থাৎ এক সা পনির বা এক সা যব বা এক সা খেজুর অথবা এক সা কিশমিশ।

সাদাকাতুল ফিতর কখন আদায় করতে হয়?

ফিতরা আদায় করার উত্তম সময় হচ্ছে ঈদের নামাজ বের হওয়ার পূর্বক্ষণে। অর্থাৎ ফিতরা দিয়ে নামাজ পড়তে যাওয়া।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদের নামাজ আদায়ের পূর্বে ফিতরা আদায় করার আদেশ দিতেন। (সহি বুখারি : ১৫০৩)

ইবনে ওমর থেকে বর্ণিত, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যাকাতুল ফিতর আদায় করার আদেশ দেন লোকদের নামাজে বের হওয়ার পূর্বে।’ (বুখারি: ১৫০৯) তবে ফিতরা দেওয়ার সময় শুরু হয় রমজানের শেষ দিনে সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে। (সউদি ফাতাওয়া কমিটি ৯/৩৭৩)

অবশ্য কোনো কোনো সাহাবি থেকে ঈদের কয়েকদিন পূর্বেও ফিতরা আদায়ের কথা প্রমাণিত আছে। যেমন নাফে (রাহ.) বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) ঈদের দু’ একদিন পূর্বেই তা (ফিতরা) আদায় করে দিতেন। ((বুখারি: ১৫১১, সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ১৬০৬)

আর নাফে (রাহ.) থেকে অপর একটি বর্ণনায় এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) ঈদের দু’ তিনদিন পূর্বে ফিতরা উসূলকারীর নিকট সদকাতুল ফিতর পাঠিয়ে দিতেন। (মুয়াত্তা ইমাম মালেক, হাদিস : ৩১৬)

এর ভিত্তিতে আলেমরা বলেন, সদকাতুল ফিতর রমজানের শেষ দিকেই আদায় করা উচিত। এতে করে গরীব লোকদের জন্য ঈদের সময়ের প্রয়োজন পূরণেও সহায়তা হয়। আর রমজানের শুরুতে বা পূর্বে ফিতরা আদায় করলেও অধিকাংশ ফকীহগণের মতে তা আদায় হয়ে যায়। (আলবাহরুর রায়েক ২/২৫৫; ফাতাওয়া খানিয়া ১/২৩২; বাদায়েউস সানায়ে ২/২০৭; রদ্দুল মুহতার ২/৩৬৭; আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৩৮৪; তাবয়ীনুল হাকায়েক ২/১৪২)

সাদাকাতুল ফিতর কিভাবে আদায় করবেন?

যেসব খাদ্যবস্তু স্বাভাবিক তাপমাত্রায় সহজে সংরক্ষণযোগ্য, সহজে বিনিময়যোগ্য ও বাজারমূল্য স্থিতিশীল থাকে; সেসব খাদ্যদ্রব্য দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করা যায়। মুজতাহিদ ফকিহগণ বলেন যেখানে যা প্রধান খাদ্য, তা দ্বারা ফিতরা আদায় করা শ্রেয়।

ইবনে উমর (রা.) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) স্বীয় উম্মতের ক্রীতদাস ও স্বাধীন, নারী ও পুরুষ, ছোট ও বড় সকলের উপর মাথা পিছু এক ‘সা’ পরিমাণ খেজুর বা যব যাকাতুল ফিতরা হিসাবে ফরজ করেছেন এবং তা ঈদগাহের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পূর্বেই আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন’। (বুখারি-মুসলিম, মিশকাত হা/১৮১৫)

হজরত মুআবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান (রা.) হজ বা ওমরাহ উপলক্ষে মদিনায় এলেন, তিনি জনগণের উদ্দেশে মিম্বরে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিলেন। তখন তিনি আলোচনা করলেন সে বিষয়, যে বিষয়ে মানুষ প্রশ্ন করেছে। তিনি বললেন, ‘আমি দেখছি শামের দুই মুদ (নিসফ সা বা পৌনে দুই কেজি) আটা সমান হয় (মূল্যমান হিসেবে) এক সা (৩ কেজি ৩০০ গ্রাম) খেজুরের। অতঃপর মানুষ (সাহাবায়ে কিরাম ও তাবিয়িগণ) এই মত গ্রহণ করলেন। (মুসলিম)

আটা বা গমও এক সা (৩ কেজি ৩০০ গ্রাম) দেওয়া উত্তম। হজরত হাসান বসরী (রহ.) বর্ণনা করেন, হজরত আলী (রা.) বললেন, ‘আল্লাহ যখন তোমাদের প্রাচুর্য দিয়েছেন তোমরাও উদার হও, গমও এক সা দাও।’ (নাসায়ি)

ইমাম আবু হানিফা (রহ.)–এর মতে অধিক মূল্যের দ্রব্য দ্বারা ফিতরা আদায় করা উত্তম; অর্থাৎ যা দ্বারা আদায় করলে গরিবদের বেশি উপকার হয়, সেটাই উত্তম। ইমাম শাফিঈ (রহ.)–এর মতে, হাদিসে উল্লিখিত বস্তুসমূহের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বোচ্চ মূল্যের দ্রব্য দ্বারা সদকা আদায় করা উত্তম। অন্য সব ইমামের মতও অনুরূপ।

সাদাকাতুল ফিতর কাদের প্রদান করবেন?

ফিতরা তাঁদের দেওয়া যায়, যাকাত যে আটটি খাতে প্রদান করা যায়। কোরআন করিমের বর্ণনা, ‘মূলত সদাকাত হলো ফকির, মিসকিন, যাকাতকর্মী, অনুরক্ত ব্যক্তি ও নওমুসলিম, ক্রীতদাস, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি, আল্লাহর পথে (ইসলাম সুরক্ষার জন্য), বিপদগ্রস্ত বিদেশি মুসাফির ও পথসন্তানদের জন্য। এটি আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞানী ও পরম কৌশলী।’ (সুরা-৯ তাওবাহ, আয়াত: ৬০)

যাকাত কি?

যাকাত (الزكاة) (আরবি: زكاة zakāt, "যা পরিশুদ্ধ করে", আরও আরবি: زكاة ألمال, "সম্পদের যাকাত") হলো ইসলাম ধর্মের পঞ্চস্তম্ভের একটি। প্রত্যেক স্বাধীন, পূর্ণবয়স্ক মুসলমান নর-নারীকে প্রতি বছর স্বীয় আয় ও সম্পত্তির একটি নির্দিষ্ট অংশ, যদি তা ইসলামী শরিয়ত নির্ধারিত সীমা (নিসাব পরিমাণ) অতিক্রম করে তবে    গরীব-দুঃস্থদের মধ্যে বিতরণের নিয়মকে যাকাত বলা হয়। সাধারণত নির্ধারিত সীমার অধিক সম্পত্তি হিজরি ১ বছর ধরে থাকলে মোট সম্পত্তির ২.৫ শতাংশ (২.৫%) বা ১/৪০ অংশ বিতরণ করতে হয়। ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের মধ্যে হজ্জ্ব এবং যাকাত শুধুমাত্র শর্তসাপেক্ষ যে, তা সম্পদশালীদের জন্য ফরয বা আবশ্যিক হয়। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআনে "যাকাত" শব্দের উল্লেখ এসেছে ৩২ বার। নামাজের পরে সবচেয়ে বেশি বার এটি উল্লেখ করা হয়েছে।

যাকাত ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিধান। কুরআনের বহু স্থানে সালাতের আদেশের সঙ্গে যাকাতের আদেশ দেওয়া হয়েছে। যাকাত ফরয হবার বহু পূর্বে দান করার অর্থে যাকাত দেবার নির্দেশ নাযিল হয়।

ইরশাদ হয়েছে, সালাত কায়েম করে যাকাত প্রদান কর এবং আল্লাহকে দাও উত্তম ঋণ (কর্যে হাসানা) তোমরা তোমাদের মঙ্গলের জন্য অগ্রিম যা কিছু প্রেরণ করবে তোমরা পাবে আল্লাহর নিকট। ওটাই উৎকৃষ্টতর এবং পুরস্কার হিসেবে মহত্তর। আর তোমরা ক্ষমা চাও আল্লাহর নিকট। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। (সূরা মুয়াজ্জিম : আয়াত ২০)।

মহানবী হযরত  মুহাম্মদ (স.)  যখন ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মদিনায় গিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা চালু করেন, তখন সে রাষ্ট্রে যাকাত ব্যবস্থার প্রচলন শুরু হয়।

নিসাব কি?

নিসাব একটি ইসলামি শব্দ। এর মানে হচ্ছে দৈনন্দিন প্রয়োজন পূরণ ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী বাদ দেয়ার পর সাড়ে বায়ান্ন তোলা পরিমাণ রূপা অথবা সাড়ে সাত ভরি পরিমাণ স্বর্ণ থাকলে অথবা এর সমমূল্যের ব্যবসায়িক পণ্যের মালিকানা থাকলে তাকে যাকাতের নিসাব বলে।

ধর্মের নিয়ম অনুযায়ী নিসাব পরিমাণ সম্পদ এক বছর অতিবাহিত হলে যাকাত দিতে হবে। ধরুন, এক জনের কাছে সাড়ে সাত ভরির চাইতে সামাণ্য বেশি স্বর্ণ আছে। ধরা যাক ওই স্বর্ণ তিনি বাজারে ৪ লাখ টাকায় বিক্রি করতে পারবেন। এটাই নিসাব পরিমাণ সম্পদ। এখন তাকে এই নিসাবের জন্য শতকরা আড়াই টাকা হিসেবে দশ হাজার টাকা যাকাত দিতে হবে।

নিসাবের পরিমাণ

সাড়ে ৭ তোলা স্বর্ণ অথবা ৫২ তোলা রৌপ্য অথবা সমমূল্যের নগদ অর্থ বা ব্যবসা পণ্য থাকে, তবে তঁার সম্পদের শতকরা আড়াই শতাংশ হিসাবে আল্লাহর নির্ধারিত খাতে গরিব-মিসকিনদের মধ্যে বণ্টন করতে হয়।

সারা বছর নিজের ও পরিবারের যাবতীয় খরচ বাদ দিয়ে কোনো মুসলমানের কাছে নিসাব পরিমাণ অর্থাৎ কমপক্ষে সাড়ে ৭ তোলা স্বর্ণ অথবা সাড়ে ৫২ তোলা রৌপ্য অথবা সমমূল্যের নগদ অর্থ বা ব্যবসা পণ্য থাকে, তবে তঁার সম্পদের শতকরা আড়াই শতাংশ হিসাবে আল্লাহর নির্ধারিত খাতে গরিব-মিসকিনদের মধ্যে বণ্টন করতে হয়—এটাই হলো যাকাত। ধনসম্পদের ৪০ ভাগের ১ ভাগ অসহায় গরিব-দুঃখীদের যাকাত প্রদান করে মুমিনের আত্মিক প্রশান্তি লাভ করে থাকেন। যাকাত গরিবের প্রতি ধনীর অনুগ্রহ নয়; বরং তাদের ন্যায্য অধিকার।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘তাদের (সম্পদশালীদের) ধনসম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতের হক।’ (সুরা আল-জারিআত, আয়াত: ১৯)

মনে রাখবেন- আপনার নিকট নিসাব পরিমাণ স্বর্ণ কিংবা রৌপ্য না থাকলেও তার সমমূল্যের নগদ অর্থ থাকলে আপনার উপর যাকাত ফরজ।

কখন যাকাত দিবেন?

যাকাত দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময়ের বাধ্যবাধকতা না থাকলেও রমজান মাসই যাকাত আদায়ের সর্বোত্তম সময়। ফলে বিত্তবানেরা দান-সদকা ও যাকাত-ফিতরা প্রদানে উৎসাহিত হন। রমজান মাসে দান-সদকা করলে অন্য সময়ের চেয়ে ৭০ গুণ বেশি নেকি হয়।

যদি কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য একটি নফল ইবাদত করেন, তবে তিনি মাহে রমজানে একটি ফরজ ইবাদতের সমান সওয়াব পাবেন। যিনি একটি ফরজ আদায় করবেন, তিনি অন্যান্য মাসের ৭০টি ফরজের সমান সওয়াব পাবেন। তাই রমজান মাসে রোজাদার মুমিন বান্দারা একসঙ্গে গরিবের হক যাকাত ও ফিতরা—এ দুটি আর্থিক ইবাদত করে থাকেন।

দারিদ্র্য দূরীকরণ ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে যাকাত শ্রেষ্ঠতর উপায়। রোজাদার ধনী লোকেরা অসহায়দের যাকাত প্রদান করার ফলে সমাজের গরিব-নিঃস্ব ব্যক্তিরা দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে রেহাই পায় এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হয়। ধনী মুসলমানদের অর্থসম্পদের মধ্যে আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী গরিবের নির্দিষ্ট পরিমাণ অধিকার রয়েছে। অন্যের এ ন্যায্য প্রাপ্য বা হক প্রদান করলেই অবশিষ্ট ধনসম্পদ পবিত্র হয়ে যায়। রমজান মাসে ধনী লোকেরা দরিদ্রদের যাকাত প্রদানের ফলে উভয় শ্রেণির মানুষের মধ্যে লেনদেন হয় এবং পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে ওঠে।

নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যাকাত ইসলামের সেতু।’ (মুসলিম)

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রতিটি বস্তুরই একটি যাকাত রয়েছে, আর মানুষের দেহের যাকাত হলো রোজা।’ (ইবনে মাজা)। রোজাকে দেহের যাকাতস্বরূপ বলা হয়েছে, যাকাত আদায় করলে যেমন মানুষের উপার্জিত সব সম্পদ পবিত্র হয়, তেমনি রমজান মাসে রোজা পালন করলে সারা শরীর পবিত্র হয়ে যায়। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘যে ব্যক্তি তার সম্পদের যাকাত প্রদান করে, তার সম্পদের দোষ দূর হয়।’ বস্তুর পবিত্রতা হাসিলের জন্য যেমন যাকাত প্রদান করতে হয়, তেমনি মানুষের শরীর তথা আত্মার পরিশুদ্ধির জন্য সত্যিকারের সিয়াম পালন করতে হয়।

যাকাত কারা পাবেন?

কাকে যাকাত দেওয়া যায় এবং কাকে দেওয়া যায় না, এ ব্যাপারে ইসলামে স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া আছে। কোরআনে বলা হয়েছে যে ফকির, মিসকিন, যাকাত আদায় কর্মী, নও মুসলিম ও অনুরাগী, দাস-দাসী, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি, মুজাহিদ ও বিপদগ্রস্ত মুসাফিরকে যাকাত দিতে হবে। যাকাতের অর্থ বা সম্পদ বিতরণের বিষয়ে কোরআনে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

পবিত্র কোরআনে সুরা তাওবার ৬০ নম্বর আয়াত অনুযায়ী যারা যাকাত পাওয়ার উপযোগী, তারা হলেন-

  • ১. ফকির: যার বেঁচে থাকার মতো সম্বল নেই বা খুব সামান্য।
  • ২. মিসকিন: এমন অভাবী, যার রোজগার তার নিজের এবং তার ওপরে নির্ভরশীলদের অপরিহার্য প্রয়োজন মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়।
  • ৩. যাকাত সংগ্রহ ও বিতরণকাজে নিয়োজিত কর্মচারী, যাদের আমিলিন বলে।
  • ৪. নব্য মুসলিম যার ইমান পরিণত হওয়ার পথে আছে অথবা ইসলাম গ্রহণ করতে ইচ্ছুক কোনো অমুসলিম।
  • ৫. মুক্তিপণ ধার্যকৃত দাস বা রিকাব।
  • ৬. ঋণী ব্যক্তি যিনি যাকাতের অর্থে ঋণ পরিশোধ করতে চান।
  • ৭. আল্লাহর পথে ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজে সক্রিয়ভাবে নিয়োজিত ব্যক্তি (মুজাহিদ)।
  • ৮. বিপদগ্রস্ত মুসাফির।

যাদের যাকাত দেওয়া যায় না

নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক, যে ব্যক্তি ৮৫ গ্রাম সোনা বা ৫৯৫ গ্রাম রুপার সমপরিমাণ নগদ অর্থ বা সমমূল্যের দ্রব্যসামগ্রী বা বাণিজ্য পণ্যের মালিক, তাকে যাকাত দেওয়া যায় না। এমন ব্যক্তির যাকাত গ্রহণ নিষেধ। নিসাব পরিমাণ সম্পদের অধিকারীকে যাকাত দিলে আদায় হবে না।

কেউ তার আপন মা, বাবা, মাতামহ, মাতামহী, পিতামহ ও পিতামহী এবং তাদের পিতা-মাতাকে যাকাত দিতে পারবে না। একইভাবে নিজের ছেলে, মেয়ে, নাতি ও নাতনি এবং তাদের সন্তানদে যাকাত দেওয়া যায় না। আবার স্বামী স্ত্রীকে যাকাত দিতে পারবেন না। স্ত্রী স্বামীকে যাকাত দিতে পারবেন না।

শ্রমিককে তার পারিশ্রমিক হিসেবে যাকাত দেওয়া যায় না । অথবা গৃহভৃত্য বা অন্য কোনো কর্মচারীকে মজুরি হিসেবে যাকাত দেওয়া যায় না। অবশ্য মজুরি ছাড়া উপহার হিসেবে তাদের যাকাত দেওয়া যায়।

সর্বোপরি, নবী (স.) এর বংশধরদেরও যাকাত প্রদান করা যাবে না।

কেউ যদি ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে কি যাকাত দিতে হবে?

মুফতি মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ বলছেন, ব্যাংক থেকে ব্যক্তিগত ঋণ নিলে সেটি আগামী এক বছরের কিস্তির সমপরিমাণ টাকা বাদ দিয়ে বাকী টাকার ওপর যাকাত প্রযোজ্য হবে। টাকা-পয়সা ব্যবসায় না খাটিয়ে এমনি রেখে দিলেও তাতে যাকাত ফরয হয়।

কিন্তু কারো ঋণ যদি এতো হয় যা বাদ দিলে তার কাছে নিসাব পরিমাণ যাকাতযোগ্য সম্পদ থাকে না তাহলে তার ওপর যাকাত ফরয নয়।

কোন ধরণের সম্পদের ওপর যাকাত প্রযোজ্য না?

মিস্টার আব্দুল্লাহ বলছেন বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে রাখা প্লট, ফ্ল্যাট বা জমির যাকাত দিতে হবে। কিন্তু বাড়ি করার জন্য রাখা প্লট বা জমির যাকাত দিতে হবে না।

আবার কেউ যদি সন্তানের জন্য বা এ ধরনের ব্যবহারের জন্য ফ্লাট রাখেন সেটারও যাকাত প্রযোজ্য হবে না। কারও দোকান থাকলে সেখানে থাকা পণ্যের ওপর যাকাত দিতে হবে, কিন্তু দোকান ভবন বা জমির ওপর যাকাত প্রযোজ্য হবে না।

দাতব্য সংস্থায় যাকাত কি যাকাতের অর্থ দেয়া যাবে?

মুফতি মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ বলছেন যাকাত আদায় শুদ্ধ হওয়ার জন্য যাকাত গ্রহীতাকে সে অর্থের মালিক বানিয়ে দিতে হয়। যাতে করে সে নিজ ইচ্ছায় বা স্বাধীনভাবে নিজের প্রয়োজনে তা ব্যবহার করতে পারে।

"সংস্থায় টাকা দিলে সেটি ব্যয়ের অধিকার তো সুনির্দিষ্টভাবে সেই গরীব বা মিসকিন থাকছে না। এ টাকার মালিক নির্দিষ্টভাবে কোন গরীব বা মিসকিন হয় না। সে কারণে যাকাত হিসেবে নগদ টাকা দেয়াই উত্তম," বলছিলেন তিনি।

মনে রাখতে হবে

যাকাত সমাজে ধনী ও গরিবের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগরণের একটি বিরাট উপকরণ। কোনো ব্যক্তির উপার্জিত অর্থের পুরোটাই এককভাবে তাঁকে ভোগ করার অধিকার দেওয়া হয়নি, বরং বছরান্তে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নিসাব পরিমাণ সম্পদ হলে এর দ্বারা গরিব আত্মীয়স্বজন, নিঃস্ব, হতদরিদ্র লোকজনকে সাহায্য করতে হয়; যাতে তারাও উপার্জনক্ষম হতে পারে।

যাকাত প্রদান করলে যাকাতদাতার ধনসম্পদ কমে না, বরং আল্লাহ এতে অনেক বরকত দান করেন এবং তা বহুগুণ বেড়ে যায়।

সঠিক হিসাব অনুযায়ী যাকাত প্রদান করা হলে পুরো সম্পত্তিই হালাল হয়ে যায়। যাকাত হিসেবে যেকোনো পরিধেয় বস্ত্রের চেয়ে নগদ অর্থ পেলেই মনে হয় গরিব অসহায় মানুষেরা অধিকতর খুশি হবে। যাকাতের নগদ অর্থ দিয়ে তারা প্রয়োজনে পছন্দমাফিক কাপড়চোপড় কিনবে, নয়তো সংসার নির্বাহে ব্যয় করে সাময়িকভাবে অভাব দূর করতে পারবে।

শাড়ি-লুঙ্গির চেয়ে তাদের সাংসারিক অনটন ও দারিদ্র্য নিরসনের লক্ষ্যে উপযুক্ত হারে নগদ অর্থ দ্বারা যাকাত আদায় করা হলে তারা সত্যিকারভাবে উপকৃত হবে।

প্রত্যেক ধনী ব্যক্তিরই যাকাত আদায় করা উচিত। রমজান মাসে বঞ্চিত ব্যক্তিদের অধিকার রক্ষায় ও সমাজের ধনী-দরিদ্রের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণে যাকাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। যাকাতের প্রকৃত হকদার হচ্ছে তারা, যারা কর্মক্ষমতাহীন এবং কর্মক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যারা উপার্জনহীন অথবা পর্যাপ্ত পরিমাণে উপার্জন করতে পারছে না।

ধনী লোকেরা যদি রমজান মাসে আর্থিক ইবাদত হিসেবে অগ্রিমও যাকাত আদায় করেন, তাহলে সব ধরনের গরিব মানুষের অভাব দূরীকরণ, দারিদ্র্য বিমোচন, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধান সহজ হতে পারে। যাকাতকে সঠিক খাতে এবং সহায়-সম্বলহীন দুস্থ-এতিমদের ত্রাণ-পুনর্বাসনের কাজে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে সমাজ থেকে অভাব-অনটন ও দারিদ্র্য বিমোচন করা সম্ভব হবে।

ইসলামি বিধান অনুসারে যাকাত প্রদানের ফলে সমাজের অসহায় গরিব-দুঃখী, অনাথ, বিধবা, বৃদ্ধ, রুগ্ণ, পঙ্গু, অক্ষম ও ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির মৌলিক চাহিদা পূরণের মাধ্যমে অভাব মোচন করতে পারে।

যাকাতের অর্থ-সম্পদ অভাবী ও দুস্থ মানুষের হাতে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বণ্টিত হলে তাদের দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়ক হয়। ধনী লোকেরা যদি ঠিকমতো যাকাত আদায় করেন, তাহলে সমাজে কোনো অন্নহীন, বস্ত্রহীন, আশ্রয়হীন, শিক্ষাহীন লোক থাকতে পারে না।

নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যখন কোনো বান্দা যাকাত আদায় করে, তখন ফেরেশতারা তার জন্য দোয়া করে।’

 

Comments

    Report

    Please Select a problem
    If someone is in immediate danger, get help before reporting to us. Don't wait.