শাখা সমূহ

আধুনিক মালয়েশিয়ার প্রধান রূপকার ডাঃ মাহাথির মোহাম্মদ, বিশ্বের সফল সপ্নদ্রষ্টা

আধুনিক মালয়েশিয়ার প্রধান রূপকার ডাঃ মাহাথির মোহাম্মদ বিশ্বের সফল রাষ্ট্রনেতাদের মধ্যে অন্যতম একজন। একটি অর্থনৈতিক দৈন্যদশাগ্রস্থ দেশকে টেনে তুলতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তিনি। ১৯৭৬ সালে প্রথমবারের মত উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করার পর কিভাবে মালয়েশিয়াকে বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করা যায় তা নিয়ে কাজ করে চলেছেন তিনি। এবং ১৯৮১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হুসেইন উনের পদত্যাগের পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। তিনি সফল হয়েছে মালয়েশিয়াকে আধুনিক মালয়েশিয়ায় রূপান্তর করতে। ফলে স্বীয় দেশের পাশাপাশি বিশ্বের গণমানুষের কাছে বর্তমানে একটি আদর্শের নাম ডাঃ মাহাথির মোহাম্মদ।

১০ই জুলাই ১৯২৫ সালে মালয়েশিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় এ্যালোর সেটর শহরের এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন ডাঃ মাহাথির মোহাম্মদ। মোট ৯ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্ব কনিষ্ঠ। তার পিতা মুহম্মদ ইস্কান্দার ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি সরকারি অডিটর হিসেবে কাজ করেছিলেন।

তবে ২০১৪ সালে ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেসের (ইউআইটিএস) এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মাহাথির মোহাম্মদের পূর্বপুরুষ বাংলাদেশি বলে দাবি করেছিলেন তিনি। সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি বলেন-

“চট্টগ্রাম জেলার কাপ্তাই উপজেলার রাঙ্গুনিয়ার কোন একটি গ্রামে আমার দাদার বাড়ি ছিলো এবং দাদা পরবর্তীতে মালয়েশিয়াতে বসতি স্থাপন করেন।”

তাঁর এই কথার সূত্রধরেই খোঁজ নিয়ে যানা যায় চট্টগ্রামের উত্তরাংশে রাঙ্গুনিয়া উপজেলাধীন চন্দ্রঘোনা ও কাপ্তাইগামী সড়কের সামান্য পূর্বে কর্ণফুলী নদীর তীরে অবস্থিত মরিয়মনগর নামে একটি প্রসিদ্ধ গ্রাম রয়েছে। ঐ গ্রামের এক যুবক ছিলো জাহাজের নাবিক। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে তিনি ব্রিটিশ শাসিত মালয়েশিয়া গমন করেন। এবং সেখানাকার এ্যালোর সেটর শহরের এক মালয় রমণীকে বিয়ে করেন। যার ঘরে জন্ম নেন মুহম্মদ ইস্কান্দার। যিনি ছিলেন মাহাথির মোহাম্মদের পিতা। [তথ্যসূত্র]

শৈশবে মাহাথির প্রথমে মালয় ও পরে এ্যালোর সেটর শহরের একমাত্র ইংরেজি স্কুলে শিক্ষা লাভ করেন। তার মা ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ায় মায়ের কাছেই পবিত্র কোরআন শিক্ষা লাভ করেন। এছাড়াও একজন ধর্ম শিক্ষক ছিলেন যিনি প্রতিদিন বাড়িতে এসে পবিত্র কোরআন, ইসলাম ধর্মের উপর বিশ্বাস এবং ধর্মীয় বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান ও নীতি-নৈতিকতা শিক্ষা প্রদান করতেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে জাপান মালয়েশিয়া দখল করে নেয় এবং ১৯৪১ সালে তারা ইংরেজি মাধ্যম স্কুল বন্ধ করে দেয় এবং একটি জাপানি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। তখন ষোল বছর বয়সী মাহাথির মোহাম্মদ জাপানি স্কুলে যাওয়ার পরিবর্তে স্থানীয় বাজারে কলা বিক্রি করতে শুরু করেন। কিন্তু পিতার চাপে জাপানি স্কুলে ভর্তি হন। মালয়েশিয়ায় জাপানি শাসন তিন বছর স্থায়ী ছিলো।

১৯৪৭ সালে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য মাহাথির বর্তমান সিঙ্গাপুরের কিং এডয়ার্ড মেডিসিন কলেজে ভর্তি হন এবং চিকিৎসা শাস্ত্রে অধ্যয়ন সমাপ্ত করেন। কিং এডয়ার্ড মেডিসিন কলেজে অধ্যায়ন কালে সিথি হাসমা নামে এক মেয়ের সাথে সাক্ষাৎ হয়। সিথি হাসমা তখন দ্বিতীয় মালয় মহিলা হিসেবে সিঙ্গাপুরে বৃত্তি নিয়ে একই কলেজে চিকিৎসাশাস্ত্র পড়ছিলেন। পরে তাঁরা উভয়ে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

১৯৫৩ সালে চিকিৎসা শাস্ত্রে অধ্যায়ন শেষ করে সিঙ্গাপুর থেকে মালয়েশিয়া ফিরে এসে ডাঃ মাহাথির মোহাম্মদ একজন চিকিৎসক হিসেবে চাকুরীতে যোগ দেন। কিন্তু মালয়েশিয়ার স্বাধীনতার ঠিক পূর্বে তিনি সরকারি চাকুরী ছেড়ে নিজ শহর এ্যালোর সেটরে মাহা-ক্লিনিক নামে একটি প্রাইভেট ক্লিনিক শুরু করেন। শহরের পাঁচটি প্রাইভেট ক্লিনিকের মধ্যে এটি একমাত্র মালয় বংশভূত ব্যক্তি মালিকানাধীন ক্লিনিক ছিল।

এ ক্লিনিকের বৈশিষ্ট্য ছিলো অন্যরকম। রোগীদের সেবায় কোন প্রকার কার্পন্য ছিলো না। মাহাথির নিজে রোগীদের বাড়িতে যেতেন এবং মাঝে মাঝে ছোট খাট অস্ত্রপচার করতেন। মাহাথিরের মতে চিকিৎসক হিসেবে তার প্রশিক্ষণ ও প্রাকটিস তার মধ্যে স্থিরতা এনেছিল ও তাকে যে কোন পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে সক্ষম করেছিল।

মাহাথির তখন সদ্য যুবক। বয়স ২০ বছরের একটু বেশি। তখনই তিনি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। একত্র করে তিনি গোপনে ‘মালয়ান ইউনিয়ন’ প্রস্তাবের বিরুদ্ধচারণ শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত জাপানীরা চলে যাবার পূর্বে তৎকালীন মালয়েশিয়াকে তারা থাই সরকারের শাসনাধীনে হস্তান্তর করে। পরবর্তীতে ব্রিটিশরা আবার ফিরে আসে এবং ‘মালয়ান ইউনিয়ন’ প্রতিষ্ঠা করে। মালয়ান ইউনিয়ন ছিলো প্রকৃত পক্ষে ব্রিটিশ উপনিবেশ। ‘মালয়ান ইউনিয়ন’ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ও প্রজাতন্ত্রের মর্যাদা ফিরে পেতে মাহাথির ও তার বন্ধুরা রাতের অন্ধকারে সারা শহরে রাজনৈতিক বাণী সংবলিত পোষ্টার লাগাতেন। এসময় তিনি ও তার বন্ধুরা সাইকেল চালিয়ে তারা সমগ্র প্রদেশ ঘুরে ঘুরে জনগনকে ব্রিটিশ বিরোধী হিসেবে সংঘটিত ও সক্রিয় করার কাজে ব্যস্ত থাকতেন। সংগঠনে মাহাথির সাধারণত সম্পাদক বা দ্বিতীয় অবস্থানটা বেছে নিতেন, কারণ দ্বিতীয় ব্যক্তিকেই বেশি সাংগঠনিক কাজ করতে হয় ও অন্য দলগুলোর সাথে যোগাযোগ রাখতে হয়।

মাহাথির প্রথম কেদাহ মালয় যুব ইউনিয়ন এবং পরে কেদাহ মালয় ইউনিয়ন নামে রাজনৈতিক দল সংগঠিত করেন যা পরবর্তিতে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন বা ইউএমএনও (UMNO) হিসেবে পরিচিত হয়।

সিঙ্গাপুরে কিং এডয়ার্ড মেডিসিন কলেজে অধ্যায়ন কালে তিনি ওই কলেজের মালয় ছাত্রদের নিয়ে ‘মালয় ছাত্র সংগঠন’ গঠন করেছিলেন। তবে এটি ছিল একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। মূলত ছাত্রদের শিক্ষার মান ও ফলাফল উন্নয়নের লক্ষ্যেই এটি গঠন করা হয়েছিল। তবে এই সংগঠন করার ফলে মাহাথিরের রাজনৈতিক জ্ঞান বৃদ্ধি পায়।

সরকারি চাকুরীতে থাকাকালীন তিনি সক্রিয় ভাবে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে পারেন নি ডাঃ মাহাথির মোহাম্মদ। তবে নিজ ক্লিনিক চালু করার পর তাঁর জাতীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ততা বাড়তে থাকে।

তিনি একবার ‘দ্যা ইকোনমিষ্ট’ পত্রিকাতে বলেছিলেন, “চিকিৎসা বিদ্যায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকের জন্য রাজনীতি একটি ভাল পেশা। একজন ডাক্তার রোগীকে পর্যবেক্ষণ করেন, স্বাস্থ্যগত ইতিহাস রেকর্ড করেন, স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন, ল্যাব পরীক্ষা করেন এবং চূড়ান্তভাবে রোগ নির্ণয় করেন। এ প্রক্রিয়াটি রাজনীতির মতই।” ১৯৭৪ সালে মন্ত্রী হবার আগ পর্যন্ত তিনি চিকিৎসা পেশা অব্যাহত রেখেছিলেন।

ইউএমএনও (UMNO) -এর প্রাদেশিক শাখার ঊর্ধ্বতন পদে তাঁকে দায়িত্ব দেয়া হলে তিনি রাজনীতিতে প্রকাশিত হন। ১৯৬৪ সালে ৩৯ বছর বয়সে জাতীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে বিপুল ভোটে এমপি পদে নির্বাচিত হন তিনি। এমপি হওয়ার পরে তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেন মালয়ীদের সমস্যার কথা বলতে, কিন্তু বারবার বাধাগ্রস্ত হন। ১৯৬৯ সালে তিনি দ্বিতীয়বার নির্বাচনে প্রার্থী হন। সেই বছর ইউএমএনও এর নেতৃত্বে জোটবদ্ধ সম্মিলিত সরকার গঠিত হয়। ১৯৬৯ সালের ৩০শে মে কুয়ালালামপুরে যখন চীনা ও মালয় জাতির মধ্যে তুমুল-দাঙ্গা শুরু হয় তখন রাজনৈতিক সংকট চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে। এই দাঙ্গার জন্য মাহাথির ইউএমএনও নেতৃত্বকে দোষারোপ করে প্রধানমন্ত্রী টুঙ্কু আব্দুর রহমানকে কড়া ভাষায় চিঠি লেখেন ও পদত্যাগের পরামর্শ দেন।

১৯৬৯ সালে মাহাথির প্রকাশ করেন তার বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত বই ‘The Malay Dilemma’। বইটিতে তিনি মালয়ীদের বিভিন্ন সমস্যার কথা সোজাসাপ্টা ভাষায় তুলে ধরেন। মেনে নিতে পারেননি নিজ দলের দলীয় নীতিও। লিখেছেন দলীয় নেতাদের দূর্নীতির বিরুদ্ধেও। বইটি নিষিদ্ধ হয়।

এসব কর্মকাণ্ডের ফলে তাকে ইউএমএনও থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরবর্তী তিন বছর তিনি রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন। এবং চিকিৎসা সেবা প্রদান করে চলেছিলেন। কিন্তু ১৯৭২ সালে ইউএমএনও ডাঃ মাহাথির মোহাম্মদকে আবার দলের সদস্য ও সিনেটর হিসেবে পুনর্বহাল করা হয়।

১৯৭৪ সালে দল নির্বাচনে জয়ী হবার পর তাকে শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়। মাত্র দুই বছর পর মাহাথির ১৯৭৬ এ উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দ্বায়িত্ব গ্রহণ করেন। এতে তিনি সফল হন। উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের জন্য অনেক কিছু করার পরিকল্পনা থাকলেও মাহাথির স্বাধীনভাবে সেগুলো বাস্তবায়ন করতে সক্ষম ছিলেন না।

তবে এ সময় তিনি মালয়েশিয়ার উন্নয়নের পথে সকল বাঁধা সমূহ চিহ্নিত করেন। এবং আধুনিক মালয়েশিয়া গঠনের পরিকল্পনা করেন।

১৬ জুলাই ১৯৮১ সালে ডাঃ মাহাথির মোহাম্মদ প্রথমবারের মতো মালয়েশিয়ার পূর্ণ ক্ষমতা লাভ করেন। ৫৫ বছর বয়সে মালয়েশিয়ার ৪র্থ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহন করেন ডাঃ মাহাথির মুহম্মদ। এসময় দেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক ছিলো। প্রধানমন্ত্রী হবার পর তিনি তার সকল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সম্পূর্ণ মুক্ত হন।

সেই থেকে টানা ২২ বছর মাহাথির মুহম্মদ মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এর মধ্যে প্রতিবার তিনি ও তার দল নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেন। মাহাথির মোহাম্মদ এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘ সময় যাবৎ নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

তার মেধা, প্রজ্ঞা ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। উন্নয়নমূলক নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে বদলে দেন মালয়েশিয়াকে। তাই তাকে বলা হয়, আধুনিক মালয়েশিয়ার জনক।

ক্ষমতায় আসার পর একের পর পরিকল্পনা গ্রহণের পাশাপাশি বাস্তবায়নও করেছেন সেগুলো। দেশটির ২০২০ সাল পর্যন্ত অর্থনৈতিক কর্মসূচিও তার ঘোষণা করা ছিল। মাহাথির শাসনামলের গুরুত্বপূর্ণ দিক। মালয়েশিয়ার সব মুসলিমের জন্য ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী হবার পর তিনি সকল বিষয় পুনঃপরীক্ষা করেন। সকল নীতি, পদ্ধতি, সরকার চালাতে প্রাত্যহিক সকল কাজ, আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করা হয়। তার সরকার সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ওয়ার্ক-ফ্লো চার্ট আর অফিস ম্যানুয়েল প্রবর্তন করেন। মাহাথির ও তার সরকার দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচি তৈরি করেন যার মাধ্যমে প্রত্যেকে তার নিজ নিজ ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন হয়। ব্যবসা এবং রাজনীতিতে ফুটপাতের লোক থেকে সর্বোচ্চ নেতৃত্ব পর্যন্ত দেশের জন্য নিজের জন্য কাজ করবে।

ব্যক্তিগত জীবনে মাহাথির অত্যন্ত পরিশ্রমী ও শৃঙ্খলাপরায়ণ। দেশব্যাপী সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অফিসে উপস্থিতির সময় রেকর্ড করার জন্যে তিনি পাঞ্চকার্ডের প্রচলন করেন। টাইম ম্যাগাজিন একবার তার পরপর ৫ দিনের অফিসে ঢোকার সময় রেকর্ড করে- সকাল ৭:৫৭, ৭:৫৬, ৭:৫৭, ৭:৫৯, ৭:৫৭। তার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হচ্ছে তিনি শুধু নিজেই পরিশ্রমী হন নি, গোটা মালয়েশিয়ান জাতিকে পরিশ্রমী করতে সমর্থ হয়েছেন।

মালয়েশিয়ানদের শিক্ষার ৯৫ শতাংশ খরচ সরকার বহন করে। এই নীতি চালু হয় মাহাথিরের আমল থেকে। আশির দশকে গৃহীত ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট পলিসি বাস্তবায়ন করা শুরু করেন তিনি। ফলাফলে, ১৯৯২ সালে নিজ দেশের সবাইকে কর্মসংস্থান দিয়ে উলটো আরও ৮ লাখ বিদেশি শ্রমিক নিয়োগ দেয় মালয়েশিয়া।

একই বছর শুধু যুক্তরাষ্ট্র আর ভারতেই ৬৫০ কোটি ডলারের বেশি পণ্য রফতানি করে।

পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার নির্মাণ, সমুদ্র থেকে ৬ হাজার ৩০০ হেক্টর জমি উদ্ধার, অত্যাধুনিক এয়ারপোর্ট তৈরি, একাধিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, হাইওয়ে নির্মাণসহ তার অসংখ্য উদ্যোগ সফল হয়েছে।

দেশে শিল্পায়নের জন্য তিনি পরিকল্পিতভাবে ছোট ও মাঝারি শিল্প কারখানা স্থাপন করেন। আশির দশকে গৃহীত National Development Policy-এর ফলে কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে দেশ এতোই উন্নত হয় যে, ১৯৯২ সালে মালয়েশিয়া নিজের শ্রমিকদের কর্মসংস্থান করেও প্রায় ৮ লক্ষ বিদেশী শ্রমিক নিয়োগ করে। সে বছরই শুধু যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতেই ৬৫০ কোটি ডলার মূল্যের মালয়েশিয়ান পণ্যসামগ্রী রপ্তানী হয়।

মাহাথির শুধু উন্নয়নই করেন নি, দেশজুড়ে জাগরণেরও জন্ম দিয়েছেন। তারই অনুপ্রেরণায় ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করা, এভারেস্ট আরোহণসহ আরও অনেক অসাধ্য কাজ মালয়েশিয়ানরা করেছে।

একজন মাহাথির বিশ্বের সকল অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের জন্যে অনুপ্রেরণা। ভান্ডারে যতটা আছে, ততটা দিয়েই কী করে উন্নয়নের প্রয়াস চালিয়ে রীতিমত সফল হওয়া যায়, তার মূর্তিমান দৃষ্টান্ত মাহাথির। তিনি মালয়েশিয়াবাসীকে শিখিয়েছেন বড় কিছু করতে, বড় কিছু চিন্তা করতে। তার উন্নয়নের মূলমন্ত্র আর অনুপ্রেরণা বুকে নিয়ে এগিয়ে চলুক প্রতিটি উন্নয়নশীল দেশ।

১৯৯০ সালেই বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ছাড়িয়ে যায় শতাংশের বেশি।

১৯৮২ সালে থাকা মালয়েশিয়ার ২৭ দশমিক ৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ জিডিপি ২০০২ সালে এসে দাঁড়ায় ৯৫ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলোর তালিকায় তলানিতে থাকা মালয়েশিয়াকে নিয়ে আসেন ১৪তম স্থানে।

আমাকে ১০ জন যুবক দাও, আমি মালয়ীদের সঙ্গে নিয়ে বিশ্বজয় করে ফেলব’- এমনি আদর্শিক চেতনা নিয়ে দারিদ্র্যের তলানিতে অবস্থান করা মালয়েশিয়াকে তুলে এনেছেন উন্নয়ন আর আধুনিকতার শীর্ষে।

আপাদমস্তক বাস্তববাদী এবং দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ ডা. মাহাথির মোহাম্মদ আক্ষরিক অর্থেই পৃথিবীর তাবত শাসকদের জন্য একটি অনুকরণীয় আদর্শ।

সম্প্রতি সি এন এনের একটি সাক্ষাৎকারে মাহাথির বলেন, আমরা ছিলাম ব্রিটিশ শাসনের অধীন। তারপর জাপানিরা আসল, তারা আমাদের থাইদের কাছে ছেড়ে দিল। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল যে, আমরা একটা ফুটবলের মতো যে কেউ আমাদেরকে এদিক সেদিক লাথি মারতে থাকল। আমার এ রকমটি পছন্দ হয়নি। আমি অনুভব করতে থাকি যে, মানুষজন আমাদের সম্মান করত না। আমার মনে হয়েছিল- অন্যদের মতো আমাদের কেউ সমানভাবে দেখা উচিত।’

মাহাথির বলেন, এই ব্যাপারটিই আমাকে সামনে আসতে উৎসাহ দেয় যে, মালয়েশিয়া অন্য দেশগুলোর মতোই একটি ভালো দেশে পরিণত হতে পারে। আমি এখানেই জন্ম নিয়েছি, বড় হয়েছি এবং আমার আশপাশের এসব লোকজন যাদের সঙ্গে আমি আমার সময় কাটিয়েছি এবং আমরা একটি সুন্দর সংস্কৃতি গড়ে তুলেছি।

মাহাথির মোহাম্মদের বিরুদ্ধে বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের ওপর দমন-পীড়নের গুরুতর অভিযোগ আছে। তাঁর জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ানো সব ব্যক্তি বা দলের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তিনি। যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন মাহাথির। আনোয়ার ইব্রাহিম ছিলেন মাহাথির পরবর্তী যুগের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ। অথচ ১৯৯৮ সালে সেই আনোয়ারকেই বরখাস্ত করেন মাহাথির। পরে তাঁর বিরুদ্ধে আনা হয় সমকামিতা ও দুর্নীতির অভিযোগ। সেই অভিযোগে সাজা পেয়েই এবারের নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি আনোয়ার।

এ বিষয়ে সিএনএন এর এক প্রতিবেদনে ডা. মাহাথির মোহাম্মদ বলেন, আমি স্বৈরশাসক ছিলাম না। আমি জনগণ দ্বারা পাঁচবার নির্বাচিত হয়েছিলাম, এবং সবচেয়ে বড় কথা কোনো স্বৈরশাসকই কখনো স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে না, অন্যদিকে আমি স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়িয়েছিলাম। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি- দেশের জন্য কাজ করা এবং একে ভালো কিছু দেয়ার সুযোগ গ্রহণ করাটা খুবই স্বস্তিদায়ক। এটা এ জন্য নয় যে আপনি টাকা কামাচ্ছেন বরং এটা এ জন্য যে আপনাকে আপনার কাজে সন্তুষ্ট রাখছে।

তিনি বলেন, আমি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছি এবং দেখেছি তারা খুবই ভালো করছে। তবে মালায়শিয়া কেন নয়? সে জন্য এটা একটি বিবেচ্য বিষয় যে, আমাদের বিবেচনা করতে হবে আমাদের সম্পদকে, আমাদের সামর্থ্যকে, আমাদের অবস্থাকে এবং সামনে আসন্ন পরিবর্তনকে যাতে আমরা আমাদের দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অবদান রাখতে পারি।

আধুনিক মালয়েশিয়ার জনক বলেন, এতটা অনুশোচনা নেই কিন্তু আমি অনুভব করি যে, এই দেশটি বিভিন্ন বর্ণের জাতির সমষ্টি। আপনি এটাকে পরিবর্তন করতে পারবেন না, ধনী-গরিবের মধ্যে, বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে কোনো তফাত থাকাকে আমি পছন্দ করি না কারণ এটা দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলবে।

এটা নিশ্চিত করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি যাতে রকম বৈষম্য বিলুপ্ত হয় এবং এক হয়ে দেশটির সব গোত্রই দেশের সব সম্পদ সমানভাবে ভোগ করতে পারবে। আমার কিছুটা সফলতা রয়েছে কিন্তু বৃহৎ অর্থে আমি ব্যর্থ।

দূর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়ার কারণে মালয়েশিয়ার উন্নয়ন হলেও দেশটির একটি মহল এই কঠোরতার তীব্র সমালোচনা করেছে। এ বিষটি নিয়ে প্রশ্ন করলে একবার মাহাথির বলেন, ‘আমরা সরকারের দায়িত্ব নেয়ার পর যে পরিস্থিতি দেখছি তাতে বিশ্বস্ত কোনো কর্মকর্তা পাওয়াই কঠিন হয়ে পড়েছে। বাইরে থেকে আমরা বুঝতে পারছিলাম, দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছে গোটা প্রশাসন। কিন্তু পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ তা প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসার আগে বুঝতে পারিনি। সরকার যাদের মাধ্যমে জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেবে, সেই শীর্ষ কর্মকর্তাদের বেশির ভাগই দুর্নীতিগ্রস্ত।’

মালয়েশিয়াকে বদলে দেবার ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমনের পাশাপাশি শিক্ষা হচ্ছে তাঁর বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। বর্তমানে মালয়েশিয়ায় শিক্ষার হার ৯০%। শিক্ষা ব্যায়ের ৯৫% সরকার বহন করছে।

মালয়েশিয়ার বহু ধর্ম মত আর বিশ্বাসের মানুষকে তিনি গেঁথেছেন একই সুতায়। তবে ২০১৮ সালে ক্ষমতায় আরোহণের মধ্য দিয়ে আবারও নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন এ নেতা।

ইসলাম সম্পর্কে “A new deal for Asia” গ্রন্থে মাহাথির বলেন, ” ইসলাম ধর্ম আমাদের জীবনের অংশ। একে পরিত্যাগ করার কোন কারণ নেই। সঠিক ভাবে ব্যাখ্যা করা হলে ধর্ম কখনই অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য বাধা হতে পারে না। ইসলামের শিক্ষা সমসাময়িক সময়ের দৃষ্টিভঙ্গিতে নিতে হবে। ইসলাম শুধু মাত্র সপ্তম শতাব্দীর ধর্ম নয়। ইসলাম অবশ্যই সর্বকালের ধর্ম।”

একটি দেশের উন্নয়নে সেই দেশের জনগণের অবদান যতটা থাকে, তার চাইতে দ্বিগুণ অবদান থাকে দেশটির শাসকের। শুধু একজন যোগ্য শাসকই পারেন একটি জাতির ইতিহাস সম্পূর্ণরুপে বদলে দিতে। এমনই একজন সুযোগ্য, দূরদর্শী ও সাহসী শাসক ছিলেন মাহাথির মুহাম্মদ। করত। টানা ২২ বছর ক্ষমতায় ছিলেন মাহাথির মোহাম্মদ। এই দীর্ঘ সময়ে মালয়েশিয়াকে এশিয়ার অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেন তিনি। ২০০৩ সালে ক্ষমতা ছাড়েন মাহাথির।

Comments

    Report

    Please Select a problem
    If someone is in immediate danger, get help before reporting to us. Don't wait.